আপনজনকে আপন আয়নায় আবলোকন অনিবার্য ।
সন্ধান চাইঃ-পাশের প্রতিচ্ছবিটি পুস্পসখা রায় এর।বয়স ঊনষাট। গায়ের রঙ শ্যামলা।উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি।চোখ পিংলা।মুখমন্ডল লম্বাটে।পরনে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী।এই মাসের পাঁচ তারিখ সকালবেলা শিমুল পাড়ার‘হারানো সুর’থেকে বেরিয়ে আর ঘরে ফেরে নি।কোন সহৃদয় ব্যক্তি সন্ধান পেলে ও নিচের নম্বরে জানালে বাধিত থাকব।
এরপর একটা ফোন নম্বর দেওয়া আছে।আজ মাসের পনের তারিখ। শ্রোতধারা বিজ্ঞাপণটি বারবার পড়ল।প্রতিদিনইপত্রিকায় এমন বহু বিজ্ঞাপণ থাকে।জন্মবার্ষিকী,বিবাহবার্ষিকী,মৃত্যুবার্ষিকীরসাথে পলাতকআসামীর,হারিয়ে যাওয়া মানুষের ও জিনিসের বিজ্ঞাপণ।শ্রোতধারা এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে আর তার মন কষ্টে ভরে যায় হারিয়ে যাওয়া লোকদের জন্য,তাদেরআপনজনদের জন্য।এমনিতেই তার মনটা নরম। সকলের জন্য তার হৃদয় বিগলিত হয়।ভিখারী বা দীনদুঃখী দেখলে সে কাতর হয়ে পড়ে।অকাতরে দান করে।সে সবাইকে আগলে রেখে সুখ পায়।দেবার মতো মনের সাথে ঈশ্বর তাকে প্রাচুর্যও দিয়েছে।প্রথম প্রথম সপ্তর্ষি ঠাট্টা ইয়ার্কি করলেও পরে শ্রোতধারাকে অন্নপূর্ণা উপাধি দিয়েছে।
বিজ্ঞাপনের দুটি শব্দ তার দেহ মনকে এতটাই আলোড়িত করেছে,মথিত করেছে যে সে ঐ শব্দদ্বয়ের বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে গেছে।ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে,কিছু বুঝা যাচ্ছে না।কিন্তু ‘পিংলা’ এবং ‘হারানো সুর’ এই শব্দবন্ধ গুলো সুতীক্ষ্ণ তীরের ফলার মতো তাকে যেন এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে।শব্দগুলো তার রক্ত কণিকায় মিশে কিসের সন্ধানে যেন শিরা উপশিরায় লহরীর পর লহরী তুলে এক ঝঞ্ঝার সৃষ্টি করেছে।ক্ষরণ শুরু হয়েছে হৃদয়ের গোপন স্থানে।স্রোতধারা আঁচ পাচ্ছে।এও কি সম্ভব?প্রায় চল্লিশ বছরের পুরনো ছবি।একই নামের কত লোকই তো থাকে।কিন্তু ঐ শব্দদুটো?রক্তকণার ঢেউ আছড়ে পড়ছে হৃদসাগরের কূলে কূলে। মনোভূমিকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছে উর্মিমালার সংঘাত।মস্তিষ্কের সংগ্রহশালায় আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল সময়ের বেড়াজাল। খড়কুটোর মতো উড়ে গেল হাজার মাইলের ব্যবধান,খসে পড়ল অবচেতন মনের স্তরীভূত ঢাকনা।
নামেই মহকুমা শহর।নেই ভাল রাস্তাঘাট,নেই ভাল স্কুল ও বিনোদনের ব্যবস্থা।একটা সিনেমাহল আছে,একটা পাবলিক লাইব্রেরি আর একটাই মোটামুটি ধরনের স্কুল।এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সস্ত্রীক রুদ্রকিশোর দত্ত এই শহরেই পোষ্টমাষ্টার হয়ে এসেছে কলিকাতা থেকে। অফিসের পেছনেই কোয়ার্টার।হাফওয়াল,তার উপর বাঁশের বেড়া ও টিনের চাল দেওয়া এল প্যাটার্নের ঘর।সামনে বড় উঠোন।উঠোনের দক্ষিণ সীমানার পাঁচিল ঘেঁষে হালদার পরিবার।দরজা-প্রামণ ভাঙা পাঁচিল দুইপাশে যোগাযোগের প্রশস্ত উপায়।বিশ্বনাথ হালদার মোটামুটি নামকরা লোক।সকলেই মানে।দুই ছেলে,এক মেয়ে।বড় ছেলে কিরণশংকর ব্যাঙ্ক অফিসার,ছোট উমাশংকর কলেজ শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখে।মেয়ে সবার বড়।মেয়ের ঘরের নাতিও বড় হয়েছে।বড় বৌমা রুবি সাক্ষাৎ দেবী।সুন্দরী,সদাহাস্য।সকলের আবদার তার কাছে।এক ছেলে,স্কুলে পড়ে। ছোট বৌমা কৃষ্ণাও সুশিক্ষিত,গুণী,তবে অন্তর্মুখী।তারও একটা ছেলে,সবে বোল ফুটেছে।বিশ্বনাথ হালদার দিলদরিয়া লোক।ঘরণী সুধাদেবীর আপন গুণে সবাই শিখেছে সকলের তরে সকলে।রুবি এসে সংসারটাকে আরো প্রাণবন্ত করেছে।উমাশংকরের ছেলে তো মা’র চেয়ে জে’মাকে বেশী জ্বালাতন করে।
রুদ্রকিশোর যেদিন বিকেলে কোয়ার্টারে উঠল সেদিন থেকেই দুই পরিবারকে কাছাকাছি টেনে নিয়েছে রুবি।রুদ্র’র ফুটফুটে মেয়ে স্রোতধারা আর ছেলে সংকর্ষণ।ভাইবোন উঠোনে হেঁটে ঘুরে দেখছিল। পাঁচিলের দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই ডাগর চোখের মেয়েটিকে ডেকে নিল রুবি।প্রাথমিক আলাপের পর নিজেই গেল কোয়ার্টারে।রুদ্রকিশোর রাশভারী লোক। দত্তগিন্নী সুচরিতাদেবী মিশুকে।রুবি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,জেঠু,আমরা আপনাদের প্রতিবেশী।আপনারা বিশ্রাম করে আমাদের ঘরে চা পান করবেন।আর আজ রাতে এখানে রান্নার ঝামেলা না করে আমার হাতে ডালভাত খাবেন।রুবির কথার ধরণ আর তার লক্ষীমন্ত মাতৃমুর্ত্তি দেখে সুচরিতা তো বটেই রুদ্রও আপত্তি করতেপারেনি।
অপরাহ্নের চা-আসরে দুই পরিবারের প্রাথমিক খবরাখবর বিনিময় হল । বাজারের কোথায় কি পাওয়া যাবে , মাছ কখন ভাল মিলবে , কোন্ দোকানের জিনিসপত্র ভাল , কোথায় ভাল চাল পাওয়া যাবে , লন্ড্রিটা কোথায় , ছেলে মেয়েকে কোথায় ভর্তি করতে হবে , গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হলে কি করবে – সব সবিস্তারে বর্ণনা করে গেলেন বিশ্বনাথ । বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেই হালদার পরিবারের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে রুদ্রকিশোররা বিগলিত ।রাতে হালদারের দুই ছেলের সাথেও পরিচয় হল । দত্ত পরিবারের মেয়েটি শুরু থেকেই হয়ে গেল রুবি বৌদির ন্যাওটা । রুবির এমনই আকর্ষন । মেয়েটির ডাকনাম ধারা ,ছেলেটির সঙ্কু ।
ধারার ক্লাশ এইট আর সঙ্কুর সিক্স । দিন যায় । দুই পরিবারের হৃদ্যতার কাহিনি এগিয়ে চলে । রুবি হয়ে গেল দুইজোড়া আধবুড়ো দম্পতির নয়নের মণি । সকলে মিলে রাতের শো-তে সিনেমা দেখার ক্ষেত্রেও রুবিই পরিকল্পনা করে , নির্দেশ দেয় , সাবাই মেনে নেয় ।
একদিন স্কুলে যাবার আগে ধারা হাতে একজোড়া লাল ফিতে নিয়ে রুবিকে বলল , বৌদি ফিতে বেঁধে ফুল করে দাও তাড়াতাড়ি । দেরি হয়ে গেল আজ । রুবি হাতের কাজ ফেলে চুলে ফিতে বাঁধতে বসে গেল । এমন সময় এক যুবক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সেখানে হাজির । যুবকের মুখমন্ডলে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি । দরজা দিয়ে শিষ দিতে দিতে ঢুকেই চিল চিৎকার , বৌদি খিদে পেয়েছে । জল দাও , ভাত দাও , ডাল দাও, মাছ দাও । আমার মধ্যপ্রদেশ ঠান্ডা করি , না হয় কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে । বলতে বলতেই দেখে চুলবাঁধনরত বৌদি আর নূতন মেয়েটিকে । মেয়েটি এমন আদপ কায়দাহীন যুবক আর দেখে নি । যুবক ব্যাগ রেখেই বলে , ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ , ওয়ান্ডারফুল । একটু থেমেই আবার চিৎকার , এ বাড়িতে কি কেউ নেই । এই যে বার বার বলছি আমার পেটে তুফান লেগেছে । অতিথি সৎকার না করে আজেবাজে কাজে ব্যস্ত থাকলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয় কিন্তু । সুধা দেবী হাসতে হাসতে বারান্দায় হাজির, বৌমা কোথায় তুমি ? তোমার জংলী দেবরটাকে আগে ঠান্ডা কর । যুবক স্বর নামিয়ে ধুপ করে প্রণাম করেই সুধাদেবীকে জড়িয়ে ধরে আর বলে ,ও আমার বড়মা গো , কেমন আছো গো , কতদিন তোমাকে দেখি না । সুধাদেবী বলে , হয়েছে , হয়েছে , এবার ছাড় । আগে হাত পা ধুয়ে নে , তারপর খাবি । চুল বাঁধা হয়ে গেলে ধারা উঠে চলে যাবার মুখেই যুবকের মুখোমুখি , পেছনে রুবি । ধারার চোখে চোখ রেখে যুবক আবার বলে , পাখির নীড়ের মতো চোখ –কোথাকার বনলতা সেন ? যুবকের পিংলা চোখে চোখ বুলিয়েই ধারা পালায় । রুবি বলে , স্বাদে তোকে সবাই জংলী বলে ? মুহূর্তেই যুবক সাষ্টাঙ্গ-প্রণামের ভঙ্গীতে রুবির পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে , আশীর্বাদ করো যেন একেবারে টারজানের মতো জংলী হয়ে যেতে পারি । আপাততঃ ভাত দাও , নতুবা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেব । হাসতে হাসতে রুবি যুবকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে , বুঝেছি , হাত পা ধুয়ে আয় আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি ।
খাবার টেবিলে যুবকের প্রশ্ন ,বৌদি এই বনলতা সেন কোথা থেকে এল ? রুবি রুদ্রকিশোরদের সব কথা বলল । রুবি এই দেবরটিকে অতিশয় স্নেহ করে । সুধাদেবীর ছোটবোনের ছেলে । বাপ মারা গেছে অনেকদিন । সম্প্রতি মাও গেছে । জেঠুর বাড়িতে থাকে । স্কুল ফাইনাল দিয়েছে ।রেজাল্ট এখনো হয়নি । সুধাদেবী আগেই বলেছিল রেজাল্টের পর পাকাপাকি এখানেই থাকবে । তার জন্য আলাদা রুম , আসবাবপত্র সব তৈরী । এ বাড়িতে এলেই সে দুটো বৌকে নাজেহাল করে ছাড়ে । রুবি জানে এই দেবরটিকে সে যদি বলে জলের নীচে ডুব দিয়ে বসে থাকতে তাও থাকবে । বিশ্বনাথবাবু তো ডাকে ছোটবাবা বলে । কিরণশংকর আর উমাশংকর বলে , বুনো তুই এলেই বাড়িটা সজীব হয়ে ওঠে । ব্যাস , সবার প্রশ্রয়ে যুবক বাড়ির বড়কর্তার ভুমিকা নেয় মাঝে মাঝে । বন্য প্রকৃতির জন্যই আসল নাম ভুলে সবাই তাকে আদর করে ‘বুনো’ বলে ডাকে ।
বিকেলে সোনাবৌদি আর রাঙ্গাবৌদির সঙ্গে চায়ের আসরে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল বুনো । সে রুবিকে সোনাবৌদি আর কৃষ্ণাকে রাঙাবৌদি বলে ডাকে । এমন সময় ধারার প্রবেশ । বুনো বলে , এই যে বনলতা সেন তোর বাড়ি কি নাটোরে ? ধারা সোজা রুবির পেছনে । বুনো বলে যায় , ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা , মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য – এই বনলতা সেন তুই কি দারুচিনি দ্বীপে থাকিস ? স্রোতধারা বিরক্ত হয়ে বলে ,
-আমার নাম বনলতা নয় , আমরা সেন নই ।বুনো হা হা করে হাসতে থাকে ।
-তাহলে তোর নাম কী ?
-তোমার নাম কী ?
বুনো থমকে যায় ।রাঙাবৌদি বলে ওর অনেক নাম –জংলী ,বুনো ; দেখছিস না কেমন বুনো চেহারা ,জংলী স্বভাব । বুনো বলে ,তাহলে তোর নাম বনলতা নয় ?
-না
-তাহলে কী ?
-তোমার নাম কী ?
- শুনিসনি ? তুই কি কানে খাটো ? ঐ যে বলল , বুনো । আমি বুনো ওল ।
-এটা কারো নাম হয় না ।
- হয় হয় । যারা বনে বনে ঘুরে বেড়ায় , গাছের মগডালে চড়ে , উঁচু পাড় থেকে ঝপাং করে জলে ঝাপ দেয় তাদের নাম বুনো হয় ।তোর নামও তো বনলতা , মানে বনের লতা ।
-রাগে লাল হয়ে ধারা বলে আমার নাম মোটেও বনলতা নয় । আমার নাম স্রোতধারা দত্ত । বলেই এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় ।আর হা হা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বুনো । রুবি বলে , দিলি তো মেয়েটাকে তাড়িয়ে ।বেচারি স্কুল থেকে এসেই একবার আমার কাছে আসে।
পরদিনও স্কুলফেরৎরুবির কাছে আসে স্রোতধারা ।রুবি তাকে একরকম ফল খেতে দেয় যা ধারা আগে কখনো দেখেনি । সে নেড়েচেড়ে দেখে ।সাদা হলুদ মেশানো , সুপুরির সাইজের চেয়ে একটু বড় । ধারা একটা খেয়ে বলে ,বাঃ কী মিষ্টি ! কী ফল এগুলো ?
-এর নাম গোলাপজাম ।
-কি সুন্দর নাম । কোথায় পেয়েছো ?
-বুনো এনেছে ওদের গ্রামের বাড়ি থেকে ।
-ঐ লোকটার আসল নাম কী ? বুনো কি কারো নাম হতে পারে ? এমন সময় বুনো ঢোকে আর বলে ,
- হয় হয় । বলে ছিলাম না যারা বনে বাদাড়ে চরে বেড়ায় , গাছে গাছে পাখির বাসা খোঁজে , বনমোরগের ডিম খায় , সজারুর পেছনে তাড়া করে , গুলতি দিয়ে ঘুঘু মেরে খায় , খরগোশের মাংস খায় তাদের বুনো নামই হয় । রুবি হাসে , আবার শুরু করে দিলি ? বুনো বলে ,এই বনলতা সেন , তুই কি পাখির বাসা দেখেছিস কখনো?
- না দেখি নি ।
- ঠিক আছে , আমি তোকে দেখাবো । পাখির নীড়ের মতো চোখ , আর বলে কিনা পাখির নীড় দেখেনি ! আচ্ছা , তোর নামের মানে জানিস ?
- না ।
-কী বোকা ।
-তোমার নামের মানে কী ?
- ঐ যে , বনের জংলী ভুত । ধারা হাসে আর বলে ,
- তোমার নাম বুনো নয় ।
-তাহলে কী ?তুই বল। আচ্ছা ,এই ফলটা আগে কোনদিন দেখেছিস?
- না ।
- এসব তোমাদের কইলকেত্তায় পাওয়া যাবে না । এসব আমাদের গাঁয়ের জিনিস । নামটা কেমন মিষ্টি দেখেছিস । তোর নামটাও খুব মিষ্টি । ধারা লজ্জিত হয়ে বলে , তোমার নামটা বল ।
-শুনবি ? তাহলে বলেই ফেলি । আমি হলাম গ্রামের রায় বাহাদুর । আমার নামে গাঁয়ের ছেলে বুড়ো সবাই কাঁপে । সবার ঘরে ঘরে আমার নামে খাবার সাজানো থাকে । আমি যখনই কারো ঘরে যাব আমার খাবার চাই ।
-তুমি কি পেটুক ?
– হু , এবার দেখছি পটাং পটাং কথা ফুটেছে ।না , তোকে আমার আসল নাম বলব না । আর আমি না বললে কেউ তোকে আমার নাম বলবার সাহস করবে না ।
এমন সময় উমাশংকরের ছেলে এসে কোমরে হাত রেখে বলে , বুনো’কা তুমি না বলেছিলে আমাকে এখন কাঁধে চড়াবে? বুনো তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে , ‘ওরে বাবা ! মহামাণ্য জং বাহাদূর ,নবাব সৌর্য্যবাহাদূর আসুন আসুন হুজুর ’ বলে সে খাটের পাশে বসে যায় । সৌর্য্য বীরদর্পে খাটে উঠে বুনোর মাথা জড়িয়ে ধরে কাঁধের দুই পাশে ছোট ছোট পা দুটো ফেলে দেয় । বুনো উঠে দাঁড়ায় আর মুখে ভ্রু ভ্রু করতে করতে বেরিয়ে যায় । সৌর্য্য হাসে , ধারাও হাসে।ধারা বলে ,
-সোনা বৌদি ওর আসল নামটা কী ?
-ওর নাম বলতে মানা করেছিল না ? জানতে পারলে লঙ্কাকান্ড করে ছাড়বে ।
-বল না , বল না ।আমি তো কাউকে বলব না ।
-হু , বলতে পারি । তবে তুই যেন ওকে বলবি না যে আমি বলেছি।
-না বলব না । বল বল ।
-ওর আসল নাম হল পুস্পসখা রায় ।
-পুস্পসখা , বাঃ বেশ সুন্দর তো ।
-তোর খুব পছন্দ হয়েছে বুঝি ? এমন সময় ধারার ছোটভাই এসে বলে , দিদি তোকে মা ডেকেছেন । দুজনে চলে যায় ।
স্কুলফাইনালের রেজাল্ট বেরিয়েছে । বুনো প্রত্যাশামতো সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে । প্রি-ইউনিভার্সিটি ক্লাশে ভর্তি হয়েছে । রেজাল্টের আগে আরো একবার এসেছিল । ধারার জন্য একটা ঘুঘু পাখির বাসা সত্যি সত্যিই এনেছিল অনেক খুঁজে । ধারার কি খুশি ! নেড়ে চেড়ে দেখে । বুনো তাকে বলেছে তার চোখ নাকি এই বাসার মতো সুন্দর । ধারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাসাটা নিয়ে পালায় । এখন বুনো এবাড়ির পাকাপাকি বাসিন্দা । তার উচ্ছলতায় , উৎপাতে সারা বাড়ি জীবন্ত হয়ে থাকে হরঘড়ি । একদিন কলেজ থেকে এসেই বলে , বড়মা ,চলো আজ সবাই মিলে সিনেমা দেখবো ,উত্তম-সুচিত্রার বই, হারানো সুর । তুমি আর মেসো হাত ধরাধরি করে দেখবে । সুধাদেবী হাসে আর জানে যে এই ছেলে যখন বেলেছে তখন যেতেই হবে । উত্তম-সুচিত্রার বই ওরা এমনিতেই খুব পছন্দ করে । দু পরিবারের সবাই মিলে রাত ন’টার শো দেখে এল । ফেরার পথেই সোনাবৌদি আর রাঙাবৌদি তো বুনোকে খুব বাহবা দিল । বুনো গেয়ে উঠে , তুমি যে আমার , ওগো তুমি যে আমার । দুই বৌ হাসে ।পরদিন বুনো বলে , বড়মা , আমাদের বাড়িটার একটা নাম দিতে হবে । কী নাম দেবো বল তো ? সুধা বলে ,বাড়ির আবার নাম কেন ?
-কী বলছ ?বিখ্যাত বিশ্বনাথ হালদারের বাড়ির একটা নাম থাকবে না?
-কি জানি বাবা ,তোর মেসোকে জিজ্ঞেস কর ।
- উহু , মেসো নয় , তুমিই বল ।
-আমি জানি না বাবা ।
-আমি একটা নাম ঠিক করেছি ।
-কী ?
-হারানো সুর ।
-দূর , এমন কোন নাম হয় কারো বাড়ির ?
-এবার হবে ।
-সবাই বলবে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা থেকে নেওয়া ।
-তাতে কি ? আমার মেসো কি উত্তমকুমারের চেয়ে কম রোমান্টিক ? সুধাদেবী হাসে , কি জানি বাবা , তোর মাথায় আবার কী ভূত চাপল কে জানে । বুনো বুঝে গেছে বড়মার সম্মতি আছে । সোনাবৌদি আর রাঙাবৌদি তো খুব খুশী । দাদারা এসবের সাতে পাঁচে নেই । ওরা জানে এই ভাইটি আর বউ দুটি যদি জুটি বাঁধে তবে দুনিয়া এক করে ছাড়বে ।ক’দিনের মধ্যাই বাড়ির গেইটে সিমেন্ট দিয়ে লেখা হল ‘হারানো সুর’। বিশ্বনাথবাবু একরাতে খাবার টেবিলে বলে , আমার ছোটবাবা বাড়ির একটা খুব সুন্দর নাম রেখেছে , যে দেখে সবাই প্রশংসা করে ।
একদিন তার নিজের ঘর থেকে বুনো দেখল সোনাবৌদি তার ঘর থেকে একটা শাড়ি-পরা মেয়েকে নিয়ে বেরুচ্ছে । বুনো দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায় আর থতমত খেয়ে যায় । ধারাকে চেনাই যাচ্ছে না । লম্বা বেণী আর শাড়িতে আরো সুন্দর লাগছে । বুনো বলে , চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা , মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য্য । ধারার লাল মুখ আরো লাল হয়ে ওঠে । সে পালায় । নবম শ্রেণির প্রথম ক্লাশ আজ । তাই সোনাবৌদির কাছে এসেছিল শাড়ি পরা শিখতে।
রুবি বুনোকে বলে মাঝে মাঝে ধারাকে অংক , ইংরেজী বুঝিয়ে দিতে । সেও সোনাবৌদির কথা রেখে মনে প্রাণে বুঝিয়ে দেয় । ধারা এখন বুনোকে বুনোদাদা বলে ডাকে ।
বুনো মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায় । ফিরে এসে সব গল্প বলে আর ধারা উন্মুখ হয়ে শোনে । কার পুকুর বৃষ্টির জলে ভরে গিয়ে মাছ বেরিয়ে গেছে আর বুনোরা জাল ফেলে সে মাছ ধরেছে ; নদীতে জল উপছে পড়েছে আর বুনো ঝাপিয়ে পড়ে করাল স্রোতের হাত থেকে গাছের লগ টেনে তুলেছে –এইসব সবিস্তারে বুনো বলে যায় আর নিবিষ্ট হয়ে শোনে ধারা । নূতন শ্রোতার কাছে গল্প বলার জন্য বুনোও উন্মুখ হয়ে থাকে । গল্প বলা আর শেষ হতে চায় না ।শুধু এক বর্ষার নয়, বিগত অনেক বর্ষার গল্প দীর্ঘতর হতে হতে উপন্যাস হয়ে যায় । বক্তা আর শ্রোতার আশ মেটে না । চড়কের মেলায় আম-কাটা-ছুরি কেনার বায়না ,বাঁশি কিনে ফু দিতে দিতে মেলায় ঘোরা , চড়ক গাছে মহাদেব ঘোরানো , চড়ক গাছের চারপাশে গৌরী গঙ্গা মহাদেবের ঢাকের তালে নেচে নেচে প্রদক্ষিণ করার গল্প – সব বুনোর কাছে নূতন স্বাদের উৎস হয়ে দেখা দেয় ।এসব ঘটনার বর্ণনা করা যে এত আনন্দের তা আগে কখনো বুঝেনি বুনো ।
দুই বৌদি দাবি করল মেলায় যাবে । নববর্ষের মেলা শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে বেশ জমজমাট হয় । ধারাকেও সঙ্গে নেওয়া হবে । বাসে চড়ে তিনমাইল ভ্রমণ যে এত আনন্দের তা আগে কখনো অনুভব করে নি বুনো । পূর্বের সব মেলায় ঘোরা্র আনন্দকে ছাপিয়ে গেল এবারের মেলার আনন্দ । মনে হল তার পিঠে যেন ডানা গজিয়েছে । সে উড়ছে । চারদিকের সব যেন অন্যরকম অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে । বৌদিরা হরেকরকম জিনিষ কিনেছে ।লক্ষীর পট ,মাটির পুতুল,বাতিদান,ঝাঁঝরিহাতা ,শাঁখা ,চুড়ি এসব মামুলি জিনিষের দোকান যে এত সুন্দর তা আগে খেয়ালও করেনি বুনো । সোনাবৌদি ধারাকে কাচেরে চুড়ি কিনে দিল আর হাতে পরিয়ে দিল ।ধারার চোখ যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে । বুন একটা চিরুণী কিনে দিল ধারাকে । ধারা লজ্জায় নিতে চাইছিল না । বুনো হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল , রাঙা মাথায় চিরুনী বর আসবে এখুনি ।ধারার রাঙামুখে যেন আবির ছড়িয়ে পড়ল। সে সোনাবৌদির পেছনে মুখ লুকিয়ে রাখল ।
ধারার এবার ক্লাশ টেন । পড়ার চাপ বেড়েছে । বুনোর কাছে যখন তখন এসে পড়া বুঝে যায় । একদিন সোনাবৌদি বুনোর ঘরে ঢুকে অপ্রস্তুত হয়ে যায় । দেখে বুনো আর ধারা মুখোমুখি বসে আছে হাতে হাত রেখে । চোখে চোখে চেয়ে আছে চুপচাপ ।সোনাবৌদিকে দেখে দুজনে থতমত খেয়ে যায় । রুবি বলে কী করছ তোমরা , এই বুঝি পড়া ? বুনো ধরা-পড়ে-যাওয়া-হাসি হাসে , ধারা বই নিয়ে পালিয়ে যায় । বুনো বৌদির দিকে তাকাতে পারে না । রুবি বসে । বুনোর চোখে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করে ।বুনোর চোখের ভাষা যেন বদলে গেছে ।বুনো তাকাতে পারে না । চোখ বুঝে ফেলে । রুবি ধীরে ধীরে বলে , বুনো কী হয়েছে ? বুনো চোখ খোলে না । রুবি চুপ করে থাকে । বুনোর পাতা বোজা চোখের কোণ বেয়েজলের রেখা নামে । রুবি বুনোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । দামাল , অশান্ত ,জংলী বুনো সোনাবৌদির স্নেহমাখা হাতের পরশে হু হু করে কেঁদে ফেলে । রুবি বলে , বুনো এই তুই কী করলি ? ওরা যে পরিযায়ী । তাছাড়া মাষ্টারমেসো যা রাশভারী । মেয়েকে কেটে জলে ভাসিয়ে দেবে ।বুনো কোন কথা বলে না ।
ধারা সোনাবৌদির সামনে আসতে চায় না । দূরে দূরে থাকে । একদিন সুযোগ বুঝে রুবি ধারাকে বলে , তোর বাবাকে চিনিস না । যা করতে চাইছিস কিছুতেই তা হতে দেবেন না উনি । ধারা সোনাবৌদিকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকোয় ।
সুধাদেবীকে সব বলে দেয় রুবী । সুধাদেবী বলে ,মা তুমি কিছু করতে পারলে করো । মেয়েটাতো খুব ভাল , কিন্তু ওর বাপ কি রাজি হবে মা ? সাহস করে একদিন সুচরিতাদেবীকে সব খুলে বলে রূবী । সুচরিতাদেবীর কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করে না । কিন্তু পরদিন থেকে ধারা আর এবাড়িতে আসছে না । সুচরিতাদেবী আসেন , তবে কেমন যেন সুর তাল কেটে গেছে মনে হয় । বুনোটা কেমন অদ্ভুতরকমভাবে শান্ত হয়ে গেছে । কিছুদিন পর সুচরিতাদেবী এসে জানাল রুদ্রকিশোর বদলি হয়ে গেছে কলকাতার কাছে ।
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটে গেল । শুধু একদিন ধারা এসেছিল । তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না । কেমন যেন প্রাপ্ত বয়স্ক লাগছিল । রুবী বুনোকে ডেকে আনল তার ঘরে । বু্নো যেন বোবা হয়ে গেছে । ধারা সব শক্তি জড়ো করে বলল, বুনোদাদা , আর কবে দেখা হবে জানিনা , আমাকে ক্ষমা করো । বুনো মুখ ফুটে শব্দ না করে বলল , তুই শুধু আমার।
যাবার আগেরদিন দুই পরিবার একসাথে আহার করল রুবীদের ঘরে । কিন্তু সেই উচ্ছলতা নেই ,প্রাণ নেই ।এরপরের গল্প সংক্ষিপ্ত । কালের নিয়মে জীবনখাতার পাতায় পাতায় নূতন গল্প লেখা হয় । পুরনোটা চাপা পড়ে যায় । কলকাতা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ছবি কিছুদিন তাজা থাকলেও ক্রমে তা ধূলিধূসরিত হতে থাকে । একদিন জমা ধূলি চাপা-পড়া লেখাকে ক্ষয় করে দেয় । স্রোতধারা কলেজ পাশ করে । বিয়েও হয়ে যায় । ছেলে মেয়ের জননী হয় । সেই মেয়েরও বিয়ে হয় । ছেলের ঘরে নাতি আসে । রুদ্রকিশোর আর সুচরিতা স্বর্গে চলে গেছেন।
সবসময় সবকিছু সমান নিয়মে চলে না । মানুষভেদেও নিয়ম ভিন্ন পথে চলে । সেই ঘটনার পর থেকে বুনোর প্রাণচঞ্চলতা কমে গেছে ।সব কাজই করে তবে প্রাণহীন ,উচ্ছলতাহীন । কলেজ পাশ করে ঠিক করেছে আর পড়বে না , মেসোর ব্যবসা দেখবে । ব্যবসা, বাড়ি সব সে সামলায় । জোর করেও সোনাবোউদি রাঙাবৌদি তার বিয়ে দিতে পারে নি । দুই বৌদিই তাকে আগলে রাখে । বড়ম্ মেসো দেহ রেখেছেন । দাদাবৌদিরা সব বুড়োবুড়ির দলে । সেও বুড়ো ।সবাইকে সে সামলিয়ে রাখে , আগলে রাখে । এই চলছিল জীবন ।
মানুষের মনের হদিস রাখা মুসকিল । কখন কোন্ মতলব সে এঁটেছে , কী তার উদ্দেশ্য কেউ টের পায় নি । যেদিন বাড়ি থেকে চলে গেল সেদিন দুই বৌদি সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে কেঁদেছে । শেষে স্থানীয় আর কলকাতার কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ।
পত্রিকার বিজ্ঞাপনের ভাষায় আটকে থেকে স্রোতধারার অতীত পরিক্রমা শেষ হতে জলের ফোঁটা পত্রিকায় পড়ল আর সে নিঃশব্দে কাঁদল । এখন ভাবছে কী হতে পারে ?ফোন নম্বরটা নিয়ে কি চেষ্টা করবে একবার খোঁজ নেওয়ার ? রাঙাবৌদি সোনাবৌদি কি বেঁচে আছে ? যদি বেঁচে থাকে ফোন করে সে কী বলবে ?